প্রকাশিত: Mon, Feb 6, 2023 4:37 PM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 7:14 PM

অমর একুশে বইমেলার ডায়েরি-৫

প্রথম সপ্তাহেই জমে উঠেছে অমর একুশে বইমেলা

রেজা ঘটক : প্রথম সপ্তাহেই জমে উঠেছে অমর একুশে বইমেলা। বইমেলার তৃতীয় ও চতুর্থ দিন শুক্র ও শনিবার হওয়ায় বইমেলায় যথেষ্ট ভীড় ছিল। যা পঞ্চমদিনেও অব্যাহত ছিল। কিন্তু প্রকাশকরা দাবি করছেন বই খুব একটা বিক্রি হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে বই কেন বেশি বিক্রি হচ্ছে না? অথচ বইমেলা শেষে শোনা যাবে প্রায় শত কোটি টাকার বই বিক্রি হওয়ার খবর!

আমার যেটা মনে হয়, যারা সত্যিকারের পড়ুয়া, তারা বইমেলা থেকে ঠিকই তার পছন্দের বইগুলো সংগ্রহ করেন। বই কেনায় পাঠকের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা থাকলে বাস্তবে যেসব বই বিক্রি হবেই। ওটুকুই আদতে আমাদের বইয়ের প্রকৃত বাজার। কিন্তু পাঠক যখন নানান কিসিমের বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে বিজ্ঞাপিত বইগুলো কেনেন, সেগুলো বইয়ের যে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে, সেই বাড়তি বাজারটুকু কার্যত আমাদের দৈন্যতা। 

আমরা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি যেখানে বই পড়ায় পাঠককে মোটেও আগ্রহ তৈরি করে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়া শেষ করে চাকরির পড়াশুনা শুরু করে। চাকরির পড়াশুনা মানে গাইড বই পড়া। পছন্দের চাকরি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তার পছন্দের বইটিও আর পড়ার সুযোগ পায় না কিংবা সময় সুযোগ করতে পারে না। 

কারণ তাকে গাইড বই নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। আর চাকরির চিন্তার পাশাপাশি তাকে পারিবারিক নানান কিসিমের খোটা ও অপমানের স্বীকার হতে হয়। একাডেমিক জীবন শেষ করেই একজন শিক্ষার্থী বুঝতে পারে তার এতদিনের একাডেমিক জীবনের পড়াশুনা আদতে চাকরিজীবনে খুব একটা কাজে লাগবে না। তাকে ভর করতে হয় চাকরি সংক্রান্ত গাইড বইয়ের ওপর। 

এই যে একাডেমিক পড়াশোনার সাথে চাকরির পড়াশোনার একটা গ্যাপ, এই গ্যাপটা কার্যত ওই শিক্ষার্থীর বাকি জীবনে সৃজনশীল ও মননশীল বই পড়ার ইচ্ছাকে ধ্বংস করে দেয়। কারণ তখন সে নিজেই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাস্তবতার কঠিন শৃঙ্খলের মধ্যে ডুবতে বাধ্য হয়। 

ফলে একসময়ে সৃজনশীল ও মননশীল বইয়ের তুখোড় বইপ্রেমী মানুষগুলোও জীবনের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে বই পড়ার জন্য আর বাকি জীবনে সময় সুযোগ করতে পারে না। আমার চাকুরিজীবী বন্ধুদের মধ্যে আমি নানানভাবে জরীপ চালিয়ে এমন বাস্তব ফলাফল পেয়েছি। তার মানে আমাদের একাডেমিক শিক্ষা পদ্ধতিতে যে বড় ধরনের গলদ আছে, সেটা এভাবে আমরা টের পাই।  

প্রশ্ন হলো- তাহলে সারা বছরের পাঠক কারা? যারা লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তারাই আদতে সারা বছরের পাঠক। বাকিরা কিছু মৌসুমী পাঠক, কিছু ঠেলায় পড়ে পাঠক, কিছু বিজ্ঞাপনের আকর্ষণে পাঠক, কিছু অমুক ভাই বা আপু বলেছেন এই বইটা ভালো সেই সূত্রে বইটা পড়েছেন কিন্তু শেষ করেননি। তার মানে নিজের ইচ্ছায় পাঠক যখন বইটি পড়া শেষ না করবে, তখন তাকে সেই নির্দিষ্ট বইয়ের পাঠক হিসেবে আমি গণ্য করব না।  বইয়ের ক্রেতা আর বইয়ের পাঠকের মধ্যে আবার বড় একটা গ্যাপ আমি লক্ষ্য করেছি। বই কিনলেই যে আপনি পাঠক তা আমি বিশ্বাস করি না। বাসার ড্রয়িংরুমে বই রেখে সমাজে নিজের স্টাটাস প্রদর্শন করার উদ্দেশ্য থেকেও অনেকে বই কেনেন কিন্তু সেসব বই আর জীবনে পড়েন না বা ছুঁয়েও দেখেন না।  

আমাদের সমাজে একটা নব্যশ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা নিজেদের বিশাল ক্যারিশমা ও অবদান দেখানোর উদ্দেশ্যে বই কিনে ড্রয়িংরুমের আলমারি বা বুকসেলফ সাজিয়ে রাখেন। বাসায় ড্রয়িংরুমে বই সাজিয়ে আনন্দ পান বটে, অথচ যার পেছনে উদ্দেশ্য ভিন্ন, তারা কিন্তু আমার কাছে মোটেও পাঠক নন। তারা বইয়ের ক্রেতা এবং প্রদর্শক। 

তার মানে কী দাঁড়ালো? বই বিক্রি বাড়লেই যে বইয়ের পাঠক বাড়ছে, তা কিন্তু মোটেও সত্য নয়। বইয়ের অনেক ক্রেতা থাকলেও বইয়ের সেই প্রকৃত পাঠক আশানুরূপ বাড়ছে না। ফলে ধীরে ধীরে আমরা একটা বই প্রদর্শক সমাজের দিকে রওনা হচ্ছি। যারা বই কিনবে, বই বাসায় রাখবে মাগার সেই বই পড়বে না।এবার প্রশ্ন হতে পারে- বই না পড়লে বই কিনে কী লাভ? আমি মনে করি, যারা বই কেনেন, তাদের কাছে বই পড়ার নেশাটা আবার যে কোনো সময়ে ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়। সেই সম্ভাবনাটুকু কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটুকু আশা তো আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। ওই টুকু আশা নিয়ে বেঁচে থাকায় কোনো দোষ নাই। 

বই মানুষের পরম বন্ধু। এই কথাটি যেদিন থেকে আমি বুঝতে শিখেছি, সেদিন থেকেই আমি বই পড়ি। মনযোগ দিয়েই পড়ি। কিন্তু যখন একটি বই আমাকে আর টানে না, জোর করেও পড়া আগায় না, তখন কিন্তু পড়ার নেশায় একটা ছেদ পড়ে। সেক্ষেত্রে সেই লেখকের আর কোনো বই আমার পক্ষে স্পর্শ করা কঠিন হয়ে ওঠে বটে! 

আমি মনে করি যে বইটি আপনি এখনো পড়েননি, সেই বইটি আপনার কাছে নতুন। এবছর বইমেলায় নতুন বই আসেনি বলে যারা ধুয়া তুলেন তারা আদতে বইপ্রেমীদের জন্য একটা খড়গ তৈরি করেন। আমি সবসময় বলি আপনার পছন্দের বইটি কিনুন এবং বইটি পড়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। বইমেলার খবরাখবর আজ আর কিছু লিখলাম না। কারণ সময় আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন থেকে বইমেলার ডায়েরিতে আমি বই নিয়ে আমার চিন্তার কথা লিখতে চেষ্টা করব। আর অবশ্যই ভালো বই পেলে তার খবর ঠিকই জানাবো। সবাইকে অমর একুশের শুভেচ্ছা।

 লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ফেসবুক থেকে